মহীশূর অধিগ্রহণ

প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৬৭-১৭৬৯ খ্রি:)(First Anglo-Mysore War)

  • ভারতবর্ষে ব্যবসা-বানিজ্য তথা সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ইংরেজদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিদের সঙ্গে মহীশূরে হায়দার আলির ( ১৭৬১-৮২ খ্রিঃ ) বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় ইংরেজরা হায়দর আলির উপর ভীষণ রেগে ছিল ও তাদের শত্রু বলে মনে করত ।
  • ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে হায়দার ইংরেজদের আশ্রিত কর্ণাটকের নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ ) শুরু হয়।
  • ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ও নিজামের মিলিত বাহিনী মহীশূর আক্রমণ করে । কিন্তু হায়দর আলি এই যুদ্ধে ইংরেজ ও নিজামের মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে ইংরেজ অধিকৃত মাদ্রাজ অধিকার করতে উদ্যত হন ।
  • অগত্যা ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের ইংরেজ কাউন্সিলার হায়দর আলির সঙ্গে মাদ্রাজ চুক্তি [Treaty of Madras] স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন ।

মাদ্রাজের সন্ধির শর্ত

  • একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি পরস্পরকে ফিরিয়ে দেবে।
  • এক পক্ষ অপর কোনাে তৃতীয় শক্তিদ্বারা আক্রান্ত হলে অন্য পক্ষ তাকে সাহায্য করবে ।

এইভাবে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই সন্ধি ছিল সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র। এর দ্বারা দুপক্ষের মধ্যে স্থায়ী কোনাে সদ্ভাব স্থাপিত হয়নি বা সমস্যারও কোনাে স্থায়ী সমাধান হয়নি। এছাড়া , এই সন্ধি ইংরেজদের কাছে ছিল তীব্র অপমানজনক।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৮০-১৭৮৪ খ্রি:)

  • প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত মাদ্রাজ চুক্তির (Madras Treaty) শর্ত ইংরেজগণ পরবর্তীকালে পালন করেন নি । ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাগণ মহীশূর আক্রমণ করলে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে স্বাক্ষরিত মাদ্রাজ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী হায়দার আলি ইংরেজ বাহিনীর কাছে সাহায্যের আবেদন করে । কিন্তু হায়দার আলির আবেদনে ইংরেজ বাহিনী কর্ণপাত করে নি এবং মহীশূরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি । ফলে হায়দর আলি অসন্তুষ্ট হন ।
  • ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা মহীশূরের অন্তর্গত ফরাসি বাণিজ্যকেন্দ্র মাহে দখল করলে হায়দার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন, শুরু হয় দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৮০-৮৪ খ্রিঃ )।
  • ওয়ারেন হেস্টিংস [Warren Hastings] তার কূটনীতির দ্বারা নিজাম ও মারাঠাদের হায়দর আলির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেন । তথাপি হায়দর আলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান । ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে পোর্টোনোভোর যুদ্ধে হায়দর আলি ইংরেজ সেনাপতি আয়ারকুটের হাতে পরাজিত হন এবং নেগাপত্তম, ত্রিঙ্কোমালি প্রভৃতি স্থান ইংরেজদের দখলে আসে । এই সময় হায়দর আলি ফারাসি সাহায্য চেয়ে পাঠান । তখন ফরাসি নৌ-সেনাপতি সাফ্রেনের অধীনে এক ফরাসি নৌবাহিনী হায়দর আলির সাহায্যে এগিয়ে আসেন । এক সংকটময় পরিস্থিতিতে হঠাৎ হায়দর আলির অকাল মৃত্যু হয় । যুদ্ধ চলাকালে হায়দার আলির মৃত্যু ঘটলে ( ১৭৮২ খ্রিঃ ), তার বীরপুত্র টিপুসুলতান ( ১৭৮২-৯৯খ্রিঃ ) বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান ।
  • ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি[Treaty of Mangalore] দ্বারা দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশুর যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি পরস্পরকে ফেরত দেয়।
  • ওয়ারেন হেস্টিংস এই সন্ধিকে ‘অপমানজনক শান্তি ’ (humiliating pacification ) বলে অভিহিত করেন।

তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯০-১৭৯২ খ্রি:)

  • লর্ড কর্নওয়ালিস – এর আমলে ইঙ্গ-মহীশূর সম্পর্ক আবার তিক্ত হয়ে ওঠে।
  • ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে টিপুসুলতান ইংরেজদের মিত্ররাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করলে তৃতীয় ইঙ্গ – মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়।
  • নিজাম ও মারাঠারা ইংরেজ পক্ষে যােগদান করে। দুবছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর ত্রি-শক্তি জোটের কাছে টিপু পরাজিত হন।
  • তার রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অধিকৃত হয় এবং তিনি শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি ( ১৭৯২ খ্রিঃ ) স্বাক্ষরে বাধ্য হন।

শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি

  • টিপু তার রাজ্যের অর্ধাংশ ইংরেজদের ছেড়ে দেন। নিজাম , মারাঠা ও ইংরেজরা এই অংশটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
  • টিপু ইংরেজদের ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণদিতে সম্মত হন। ক্ষতিপূরণের টাকার জামিন হিসেবে তিনি তার দুই পুত্রকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেন।

চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯৯ খ্রি:)

  • লর্ড ওয়েলেসলি টিপু সুলতানকে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বললে টিপু সুলতান এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৯৯ খ্রিঃ ) শুরু হয়।
  • ইংরেজ ও নিজামের যুগ্মবাহিনী মহীশূর আক্রমণ করে ( ১৭৯৯ খ্রিঃ )। পর পর দুটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে টিপু তার রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে আশ্রয় নেন।
  • শত্রুপক্ষ রাজধানী অবরােধ করে এবং তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।
  • তার মৃত্যুতে স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের পতন ঘটে এবং মহীশূরের একাংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • এই যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা এক প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর হাত থেকে অব্যাহতি পায় ।
  • ফরাসিরা ভারতে তাদের শেষ ও নির্ভরযােগ্য মিত্রের সহযােগিতা ও সাহায্য থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়। বলা যেতে পারে যে , এই যুদ্ধটি ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে ফরাসিদের বাধাদান প্রচেষ্টার স্থায়ী বিলুপ্তি।